ব্যবসা ও বিনিয়োগBengali

ঘাটতি বাজেট কী এবং এটি কীভাবে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে

অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে বাজেট একটি অপরিহার্য উপাদান যা আয় ও ব্যয়কে ভারসাম্যে রাখতে সহায়তা করে। কিন্তু অনেক সময় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যেখানে ব্যয় আয়ের তুলনায় বেড়ে যায়। তখন অর্থনীতিতে একটি বিশেষ ধরনের বাজেটের ধারণা সামনে আসে, যাকে নিয়ে প্রায়শই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু তৈরি হয়।

এই আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব ঘাটতি বাজেট কি, এর সম্ভাব্য কারণগুলো কীভাবে তৈরি হয়, অর্থনীতি ও সমাজে এর প্রভাব কতটা গভীর হতে পারে এবং ঘাটতি বাজেট কীভাবে পূরণ হয় ও এর সমাধান কীভাবে করা সম্ভব।

ঘাটতি বাজেট কী?

ঘাটতি বাজেট (Budget Deficit) হলো এমন একটি আর্থিক পরিস্থিতি যেখানে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সরকার নির্দিষ্ট সময়ে পরিকল্পিত ব্যয় মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত আয় বা রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারে না। সহজভাবে বললে, যখন ব্যয় আয়ের তুলনায় বেশি হয়ে যায়, তখন যে বাজেট তৈরি হয় তাকে ঘাটতি বাজেট বলা হয়।

অন্যভাবে বললে, বাজেট ঘাটতি মানে হলো আয় ও ব্যয়ের মাঝে নেতিবাচক ফারাক যা পূরণ করতে ঋণ, অনুদান বা অন্য কোনো অতিরিক্ত অর্থনৈতিক উৎসের প্রয়োজন হয়।

কীভাবে আয় ও ব্যয়ের ফারাক তৈরি হয়

আয় ও ব্যয়ের ফারাক বা ঘাটতি সাধারণত কয়েকটি কারণে সৃষ্টি হয়:

  • আয়ের সীমাবদ্ধতা – ব্যক্তি বা রাষ্ট্র পরিকল্পিত আয় সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে বাজেটে ঘাটতি তৈরি হয়। যেমন: কর আদায় কমে যাওয়া, চাকরি হারানো, ব্যবসায় মন্দা ইত্যাদি।
  • অতিরিক্ত ব্যয় – পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে বেশি খরচ করলে আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যায়।
  • অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি – প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি বা অর্থনৈতিক মন্দা আয়ের প্রবাহ কমিয়ে দেয় এবং ব্যয় বাড়িয়ে দেয়।
  • অর্থনৈতিক নীতি ও সিদ্ধান্ত – কখনো কখনো সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে উন্নয়নমূলক ব্যয় বাড়ায় যা সাময়িকভাবে ঘাটতি সৃষ্টি করে।

ব্যক্তিগত ও সরকারি বাজেটে ঘাটতির উদাহরণ

ব্যক্তিগত বাজেটে ঘাটতি

একজন ব্যক্তি মাসে ৫০,০০০ টাকা আয় করেন। কিন্তু যদি তিনি ৫৫,০০০ টাকা খরচ করেন (বাসা ভাড়া, খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার খরচ ইত্যাদি মেটাতে), তবে তার মাসিক বাজেট ৫,০০০ টাকা ঘাটতিতে পড়বে। এই ঘাটতি পূরণ করতে তাকে ঋণ নিতে হবে বা পূর্বের সঞ্চয় ব্যবহার করতে হবে।

সরকারি বাজেটে ঘাটতি

ধরুন, সরকারের বার্ষিক আয় (কর, শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি থেকে) ৪ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু উন্নয়ন প্রকল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য খাতে সরকারের ব্যয় দাঁড়ালো ৪.৫ লাখ কোটি টাকা। তখন সরকারের বাজেটে ৫০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি তৈরি হলো। এই ঘাটতি মেটাতে সরকার সাধারণত ঋণ নেয়, বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করে বা নতুন কর আরোপ করে।


বাজেট ঘাটতি কি সত্যিই খারাপ?


ঘাটতি বাজেট মানে সব সময় নেতিবাচক নয়, তবে এটি সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হয়। ব্যক্তিগত বা সরকারি বাজেটে ঘাটতি অল্প সময়ের জন্য সাময়িক সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে, যেমন ব্যবসায় বিনিয়োগ বাড়াতে বা জরুরি পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত ব্যয় করা।

তবে দীর্ঘমেয়াদে নিয়ন্ত্রণহীন ঘাটতি অর্থনৈতিক চাপ বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, সরকারি বাজেটে ধারাবাহিক ঘাটতি থাকলে ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পায়, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে এবং জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। তাই এটি শুধু সমস্যা নয়, বরং সঠিক পরিকল্পনা ও সমাধানের মাধ্যমে সুযোগেও পরিণত করা যায়।

সংক্ষেপে, বাজেট ঘাটতি নিজেই খারাপ নয়, বরং এটি কীভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে তার ওপরই নির্ভর করে অর্থনৈতিক ফলাফল ইতিবাচক হবে নাকি নেতিবাচক।


জাতীয় বা সরকারি বাজেটে ঘাটতির কারণ


ঘাটতি বাজেটের কারণগুলো একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত এবং প্রায়শই একাধিক কারণে একসাথে প্রভাবিত হয়। নিম্নলিখিত পাঁচটি মূল কারণ বিশেষভাবে ঘাটতি তৈরি করে এবং সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় বড় প্রভাব ফেলে।

১. কর আদায় কম হওয়া

সরকারের মূল আয়ের উৎস হলো কর, শুল্ক, ভ্যাট এবং অন্যান্য ফি। যদি কর আদায় প্রত্যাশার তুলনায় কম হয়, তবে সরকারের হাতে ব্যয় মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত অর্থ থাকে না। ফলে বাজেটে ঘাটতি তৈরি হয়।

২. সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি

সরকার উন্নয়ন প্রকল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক কল্যাণ বা অবকাঠামোগত প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় করলে আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যায়। এই অতিরিক্ত ব্যয়ও ঘাটতির প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৩. প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অপ্রত্যাশিত ব্যয়

বন্যা, মহামারি, খরাপ্রকোপ বা অন্যান্য জরুরি পরিস্থিতিতে সরকারকে হঠাৎ অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়। এই অপ্রত্যাশিত ব্যয় বাজেট ঘাটতি বাড়ায়।

৪. বৈদেশিক ঋণের চাপ

যদি কোনো সরকার পূর্বে নেওয়া বৈদেশিক ঋণের সুদ এবং কিস্তি মেটাতে ব্যর্থ হয় বা ঋণের বোঝা বেশি হয় তবে ব্যয়ের তুলনায় আয় কমে বাজেটে ঘাটতি তৈরি হয়।

৫. আমদানি-রপ্তানি ভারসাম্যহীনতা

দেশে আমদানি বেশি এবং রপ্তানি কম হলে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি দেখা দেয়। এতে সরকারকে ব্যয় মেটাতে অতিরিক্ত ঋণ নিতে হয় যা বাজেট ঘাটতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।


ঘাটতি বাজেটের প্রভাব


ঘাটতি বাজেট কেবল আয়ের ও ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে না, বরং এটি দেশের অর্থনীতি, সামাজিক ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক অবস্থার ওপরও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। নিম্নলিখিত বিভাগগুলোতে এর প্রভাব স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।

  • অর্থনীতিতে প্রভাব: ঘাটতি বাজেট দেশের অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে। যখন সরকার ব্যয় মেটাতে ঋণ নেয়, তখন ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দুর্বল হয়ে যায়।
  • সামাজিক প্রভাব: বাজেট ঘাটতির ফলে বাজারে পণ্যের দাম বাড়তে পারে, যার কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায়। মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ক্রয় ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • আন্তর্জাতিক প্রভাব: ঘাটতি বাজেট দেশের বৈদেশিক ঋণ এবং আন্তর্জাতিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ায়। ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পেলে দেশকে বিদেশি ঋণ মেটাতে নতুন ঋণ নিতে হতে পারে এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সীমিত হয়ে যায়।

ঘাটতি বাজেট কীভাবে পূরণ হয়?


ঘাটতি বাজেট পূরণ করা মানে হলো আয়ের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যয় মেটানোর জন্য কার্যকর আর্থিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বিভিন্ন দেশে এবং পরিস্থিতিতে এটি বিভিন্ন পদ্ধতিতে করা হয়।

১. দেশীয় ঋণ গ্রহণ

সরকার ঘাটতি পূরণের জন্য প্রায়ই দেশীয় ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা জনসাধারণের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন কোনো সরকার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বড় প্রকল্প শুরু করে, কিন্তু আয়ের পরিমাণ পর্যাপ্ত নয়, তখন দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্প চালানো হয়। এটি দ্রুত অর্থের জোগান দেয়, তবে সুদের বোঝা এবং ঋণ ব্যবস্থাপনার চাপ দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা হ্রাস করতে পারে।

২. বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য

অনেক সময় সরকার বিদেশি ঋণ গ্রহণ করে বা আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে অর্থনৈতিক সাহায্য পায়। উদাহরণস্বরূপ, উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রায়ই বিশ্বব্যাংক বা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে বড় ঋণ গ্রহণ করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা অবকাঠামো খাতে ঘাটতি পূরণ করে। যদিও এটি অবিলম্বে অর্থের ঘাটতি কমায়, তবে বিদেশি ঋণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সীমিত করতে পারে।

৩. বন্ড ও সঞ্চয়পত্র ইস্যু

সরকার জনগণ এবং বিনিয়োগকারীদের কাছে সরকারি বন্ড বা সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে তহবিল সংগ্রহ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো দেশ দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য ১০ বছরের সরকারি বন্ড ইস্যু করতে পারে। এতে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা সরকারের ঋণ পূরণে সাহায্য করে এবং সরকার ঋণগ্রহীতাদের সুদ দিয়ে ধারাবাহিক অর্থ সংগ্রহ নিশ্চিত করে।

৪. কর বৃদ্ধি ও নতুন রাজস্ব উৎস তৈরি

বাজেট ঘাটতি পূরণে কর বৃদ্ধি বা নতুন রাজস্ব উৎস তৈরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, সরকার উচ্চ-আয়ের শ্রেণির ওপর আয়কর বৃদ্ধি করতে পারে বা নতুন শুল্ক আরোপ করতে পারে। এছাড়াও, ডিজিটাল পরিষেবা, ট্যাক্স অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বা গ্রিন ট্যাক্সের মতো নতুন কর উৎস তৈরি করে আয় বাড়ানো যায়। এটি শুধু ঘাটতি পূরণ করে না, বরং অর্থনৈতিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে।

৫. ব্যয় সংকোচন

ঘাটতি কমানোর আরেকটি কার্যকর উপায় হলো ব্যয় সংকোচন। উদাহরণস্বরূপ, অপ্রয়োজনীয় সরকারি প্রকল্প স্থগিত রাখা, প্রশাসনিক খরচ কমানো বা শক্তি ও জ্বালানি ব্যবহারে রেশনিং করা। এমন পদক্ষেপ ঘাটতি কমায় এবং সরকারের আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।


নিষ্কর্ষ


ঘাটতি বাজেট দেশের আর্থিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত যা আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতা নির্দেশ করে। এর কারণগুলোতে কর আদায় কম হওয়া, সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৈদেশিক ঋণের চাপ এবং আমদানি-রপ্তানি ভারসাম্যহীনতা অন্তর্ভুক্ত। ঘাটতি বাজেট অর্থনীতি, সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে, যার ফলে মুদ্রাস্ফীতি, ঋণের বোঝা বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়তে পারে। 

তবে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ঘাটতি মোকাবিলা করা সম্ভব। দক্ষ কর ব্যবস্থাপনা, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ, বৈদেশিক আয়ের উৎস বৈচিত্র্যকরণ এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ঘাটতি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ঘাটতি বাজেটকে দেশের স্থিতিশীল অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে পরিণত করা যায়।

Md Sagor Hossen

Md Sagor Hossen

Sagor Hossen is the visionary behind The Sphere Chronicles! With a strong background in editorial leadership and content strategy, he launched this platform to illuminate stories that matter. His career spans several key roles in the publishing industry, blending creativity with business acumen.

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button