হুন্ডি কী: বাংলাদেশে অর্থ প্রেরণের অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতিটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা

বাংলাদেশে অর্থ প্রেরণের ইতিহাসে হুন্ডি একটি বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত মাধ্যম। প্রবাসী আয়ের বড় একটি অংশ দীর্ঘদিন ধরে এই পদ্ধতির মাধ্যমে দেশে এসেছে যা অনেকের কাছে সুবিধাজনক হলেও অর্থনীতি, আইন ও নিরাপত্তার দিক থেকে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একদিকে রয়েছে এর দ্রুততা ও সহজলভ্যতা, অন্যদিকে রয়েছে অবৈধ লেনদেন, মুদ্রা পাচার ও রাজস্ব ক্ষতির মতো বড় ঝুঁকি। ফলে এই মাধ্যমটি নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহল যেমন প্রবল, তেমনি বিশেষজ্ঞদের সতর্কতাও সমানভাবে বিদ্যমান।
এই নিবন্ধে আমরা হুন্ডির ইতিহাস, বাংলাদেশে এর জনপ্রিয়তার কারণ, কার্যপ্রণালি ও ধরন, ব্যাংকিং চ্যানেলের সাথে তুলনা, অর্থনৈতিক প্রভাব ও ঝুঁকি এবং সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো বিশদভাবে আলোচনা করব। পাশাপাশি পাঠকরা জানবেন কেন এই অবৈধ পদ্ধতি এখনও টিকে আছে এবং কীভাবে নিরাপদ ও বৈধ বিকল্পের মাধ্যমে এর ব্যবহার কমানো সম্ভব।
হুন্ডি কী?
হুন্ডি হলো একটি অনানুষ্ঠানিক অর্থ লেনদেন ব্যবস্থা যা ব্যাংক বা বৈধ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে পরিচালিত হয়। এর মাধ্যমে এক দেশ থেকে অন্য দেশে টাকা পাঠানো বা গ্রহণ করা হয় এজেন্ট, দালাল বা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে। প্রেরক তার দেশের একটি হুন্ডি এজেন্টকে অর্থ দেয় এবং সেই এজেন্টের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রাপকের দেশে অপর এক এজেন্ট সরাসরি নগদ অর্থ পৌঁছে দেয়। এই প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যাংকিং রেকর্ড থাকে না, ফলে লেনদেন গোপন থাকে।
হুন্ডির উৎপত্তি ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
হুন্ডির উৎপত্তি ভারতীয় উপমহাদেশে মধ্যযুগীয় বাণিজ্যিক লেনদেনের সময়। সেই সময়ে ব্যবসায়ীরা দূরবর্তী অঞ্চলে নিরাপদে অর্থ প্রেরণ ও গ্রহণের জন্য হুন্ডি ব্যবহার করতেন। মূলত এটি ছিল কাগজ-ভিত্তিক একটি প্রতিশ্রুতিপত্র বা বিল অফ এক্সচেঞ্জ যা একজন ব্যবসায়ী আরেকজনকে প্রদান করতেন। পরে, বাণিজ্যের সাথে সাথে প্রবাসী আয় প্রেরণেও এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আধুনিক প্রেক্ষাপটে হুন্ডির ব্যবহার
বর্তমানে হুন্ডি ব্যবহৃত হয় প্রধানত প্রবাসী আয় প্রেরণের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে যে সব দেশে বাংলাদেশের ব্যাংকের শাখা নেই বা ব্যাংকিং সেবা জটিল সেখানে প্রবাসীরা দ্রুত ও তুলনামূলক বেশি মুদ্রা বিনিময় হারের কারণে হুন্ডির দিকে ঝুঁকে পড়েন। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) এবং অনলাইন চ্যাট অ্যাপ ব্যবহার করে ডিজিটাল হুন্ডির প্রচলনও বেড়েছে যা ট্র্যাক করা আরও কঠিন করে তুলেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হুন্ডির জনপ্রিয়তা
বাংলাদেশে প্রবাসী আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও হুন্ডি মাধ্যমে দেশে আসে যার অন্যতম কারণ হলো এর সহজ, দ্রুত এবং তুলনামূলকভাবে বেশি মুদ্রা বিনিময় হার। অনেক প্রবাসী মনে করেন, আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলের জটিল কাগজপত্র, দীর্ঘ সময় এবং বিভিন্ন নীতিমালার কারণে তাদের প্রয়োজনীয় অর্থ সময়মতো পৌঁছায় না। ফলে, তারা দ্রুত অর্থ পাঠানোর জন্য হুন্ডির ওপর নির্ভর করেন।
এছাড়া অবৈধ অভিবাসীদের জন্য কিংবা যে সব দেশে বাংলাদেশের ব্যাংকের শাখা বা সেবা নেই, সেসব ক্ষেত্রে হুন্ডি প্রায় শেষ আশ্রয় হিসেবে কাজ করে। এই পরিস্থিতিতে প্রবাসীরা এমন একটি পদ্ধতি বেছে নেন যা কম সময়ে এবং তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে অর্থ পৌঁছে দেয়, যদিও তা আইনত অবৈধ এবং অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
হুন্ডির কার্যপ্রণালি ও ধরন
হুন্ডি লেনদেনের কার্যপ্রণালি মূলত বেশ সরল এবং দ্রুত সম্পন্ন হয়। আধুনিক যুগে প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এই পদ্ধতিতে ডিজিটাল মাধ্যমও যুক্ত হয়েছে যা লেনদেনকে আরও দ্রুত এবং সুবিধাজনক করেছে।
হুন্ডির কার্যপ্রণালি ধাপে ধাপে
১. টাকা প্রদান: প্রথমে প্রবাসী তার স্থানীয় হুন্ডি এজেন্টকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা প্রদান করেন।
২. লেনদেনের নির্দেশনা: ওই এজেন্ট তার বাংলাদেশের অংশীদার বা সহযোগীকে প্রাপকের জন্য সমপরিমাণ অর্থ প্রেরণের নির্দেশ দেন।
৩. টাকা প্রেরণ: বাংলাদেশে থাকা হুন্ডি এজেন্ট প্রাপককে নগদ অর্থ পৌঁছে দেন।
৪. ভেরিফিকেশন: প্রেরক ও প্রাপক মোবাইল ফোন বা মেসেজের মাধ্যমে লেনদেন সফল হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করেন।
ডিজিটাল হুন্ডির প্রক্রিয়া
প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে হুন্ডির ডিজিটাল রূপ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) ব্যবহার করে লেনদেন করা হচ্ছে যা আগের তুলনায় অধিক গোপনীয় এবং দ্রুত। এমনকি যারা অনলাইনে আয় করছে, তারাও এই ডিজিটাল মাধ্যমগুলোকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত ও সহজে টাকা প্রেরণ করতে পারেন।
১. টাকা প্রেরণ: প্রবাসী প্রথমে নিজের মোবাইল ফোনের হুন্ডি এজেন্টের অ্যাপ বা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (যেমন বিকাশ, নগদ) ব্যবহার করে টাকা পাঠানোর জন্য অনুরোধ দেন।
২. অর্থের আদান-প্রদান: বিদেশের হুন্ডি এজেন্ট সেই অনুরোধ মোতাবেক বাংলাদেশে অবস্থিত অন্য একটি এজেন্টকে নির্দেশ দেন অর্থ প্রাপককে দেওয়ার জন্য।
৩. টাকা গ্রহণ: প্রাপক তার মোবাইল ব্যাংকিং বা MFS অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন বা ব্যবহার করেন।
৪. লেনদেন নিশ্চিতকরণ: প্রেরক ও প্রাপক মোবাইল ফোনে কল বা ম্যাসেজের মাধ্যমে একে অপরকে লেনদেন সফল হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করেন।
ব্যাংকিং চ্যানেল বনাম হুন্ডি
বিষয় | ব্যাংকিং চ্যানেল | হুন্ডি |
লেনদেনের গতি | ধীর, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ সময় নিতে পারে | দ্রুত, সাধারণত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন হয় |
প্রক্রিয়ার জটিলতা | জটিল কাগজপত্র ও আনুষ্ঠানিকতা লাগে | সহজ, কাগজপত্রের প্রয়োজন হয় না, হলেও যৎসামান্য |
মুদ্রা বিনিময় হার | সরকারি হার অনুযায়ী সীমিত | প্রায়ই বেশি বা বেশি লাভজনক হার পাওয়া যায় |
আইনি স্বীকৃতি | সম্পূর্ণ বৈধ ও নিয়ন্ত্রিত | অবৈধ, আইনগত ঝুঁকি রয়েছে |
ট্র্যাকিং ও নজরদারি | সম্পূর্ণ ট্র্যাকযোগ্য ও নজরদারির আওতায় | অগণিত লেনদেন হওয়ায় কঠিন নজরদারি |
লেনদেনের নিরাপত্তা | নিরাপদ ও গ্রাহক সুরক্ষিত | ঝুঁকিপূর্ণ, প্রেরক-গ্রাহক আইনি সুরক্ষা পায় না |
সুবিধা | সরকারি সুবিধা, কর প্রমাণ পাওয়া যায় | দ্রুত লেনদেন, প্রাপকের কাছে দ্রুত অর্থ পৌঁছে |
অসুবিধা | সময় সাপেক্ষ, জটিলতা, উচ্চ ফি হতে পারে | অবৈধ, অর্থ পাচার ও মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি করতে পারে |
অর্থনৈতিক প্রভাব ও ঝুঁকি
হুন্ডির ব্যবহার বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রথমত, বৈধ রেমিট্যান্স চ্যানেলে পাঠানো হওয়া কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, যার ফলে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়। এটি অর্থনীতির স্থিতিশীলতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে এবং মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
প্রতিবছর হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয় যা ইলিগ্যাল আউটফ্লো হিসেবে ধরা হয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী কয়েক হাজার কোটি টাকারও বেশি অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থ প্রতি বছর বিদেশে পাচার হয় যা দেশের রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি আর্থিক বাজারকে দুর্বল করে।
হুন্ডির কারণে দেশে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়, ডলারের ঘাটতি দেখা দেয়, এবং সরকারি কর আদায়ে বড় ধরনের লোকসান হয়। এছাড়া অর্থ পাচার ও ট্যাক্স ফাঁকির সুযোগ বাড়ায়, এটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। এই সব কারণেই হুন্ডিকে একটি বড় আর্থিক ঝুঁকি হিসেবে দেখা হয়।
সরকারের পদক্ষেপ ও চ্যালেঞ্জসমূহ
বাংলাদেশ সরকার হুন্ডির অবৈধ কার্যক্রম রোধে বিভিন্ন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অপরাধ তদন্ত বিভাগ (CID) নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে হুন্ডি এজেন্টদের গ্রেফতার করছে এবং অবৈধ লেনদেনের জাল নেটওয়ার্ক ভাঙতে কাজ করছে। এছাড়াও, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি বাড়িয়ে ডিজিটাল আর্থিক সেবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে যা হুন্ডির প্রভাব কমাতে সহায়ক।
তবে, এই পদক্ষেপগুলোর পাশাপাশি সরকার ব্যাংকিং প্রক্রিয়াকে আরও সহজ ও স্বচ্ছ করতে উদ্যোগ নিচ্ছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, ২ থেকে ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা প্রদান, এবং আর্থিক সাক্ষরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈধ অর্থ প্রেরণের পথ সুগম করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারি সংস্থা, ব্যাংক, এবং আর্থিক প্রযুক্তি খাতের মধ্যে সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নিষ্কর্ষ
হুন্ডি একটি দ্রুত এবং জনপ্রিয় অনানুষ্ঠানিক অর্থ লেনদেন পদ্ধতি হলেও এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত। এর মাধ্যমে বৈধ রেমিট্যান্সে বাধা সৃষ্টি হয়, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায় এবং হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচার ঘটে। মুদ্রাস্ফীতি, ডলার সংকট, কর ফাঁকি এবং অর্থ পাচারে হুন্ডির নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। তাই সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ, ব্যাংকিং সেবার সহজলভ্যতা ও আর্থিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে হুন্ডির ব্যবহার কমানো জরুরি। নিরাপদ ও স্বচ্ছ বিকল্প ছাড়া অর্থ প্রেরণের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত নয়।